সৈকত মিস্ত্রী
‘চাঁদবণিকের পালা’ নাটকে এক অন্ধকার সময়ের বুকে আলোর সন্ধান করেছিলেন চাঁদসদাগর। বার বার তিনি খুঁজেছেন। পথ হারিয়েছেন। শম্ভু মিত্র চাঁদের মুখ দিয়ে বলিয়েও নিয়েছেন – ‘নেতা নাই।’ অন্ধকার চম্পকনগরীর দিকে তাকিয়ে বিপন্ন লক্ষিন্দর প্রশ্ন তোলেন -‘শুধুই মুখোশ? মানুষের মুখ নাই কেনো?’ ২০২৪ -এর এই লোকসভা নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে একথাই বার বার মনে হয়েছে। এ দেশের নেতা- নেত্রীদের মুখ কেন নেই? ভোটের আগে প্রতিশ্রুতির ফুলকি ছুটিয়ে জয়ের তিলকে একবার তাঁরা ললাট চর্চিত করতে পারলে পাঁচ বছরের জন্য ডুব দেন বিস্মৃতির ভুবনে। সেই মুখ ততদিনে হাওয়া। ভারতীয় উপমহাদেশের নাগরিক হওয়ার সুবাদে এমন অভিজ্ঞতা আমাদের গা সওয়া। বরং আজকাল আমরা এটাকেই স্বাভাবিক ধরে নেই। একটা স্বস্তি বোধ করি।
কালোধন ফেরতের গল্প কিংবা ফিবছর কোটি কোটি বেকারের কর্মসংস্থান যে কথার কথা সেটা নিয়ে আজকাল কেউ মাথা ঘামায় না। বরং এখন মন্দির মসজিদ আমাদের জীবনচর্চার সাথে মিশে গেছে। তাই এসব নিয়ে কথা আজকাল বড় প্রবল। তবু অন্যসব না মানা কথার কথার মতো রোগ বালাই নিয়ে, জীবনদায়ী ওষুধ নিয়ে, সরকারের তঞ্চকতা নিয়ে কথা শুনি – আজও অবাক হই। ক্ষুব্ধ হই। এই যেমন ধরুন সারা বিশ্বে যত যক্ষ্মা আক্রান্ত মানুষ আছেন, তার ২৭ শতাংশের বাস ভারতে। এদেশে ৪০ শতাংশ মানুষ যক্ষ্মার জীবাণু বহন করেন। যদিও তার বেশিভাগের রোগের কোনও উপসর্গ নেই। আবার এদেশে প্রতি বছর প্রায় ৫ লক্ষ টিবি রোগীর মৃত্যু ঘটে।হু ঘোষণা করেছে ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীকে যক্ষ্মা মুক্ত করবে তারা। এদেশের মহামহিম সরকার সেই লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে ২০২৫ সাল। অথচ মার্চ মাস থেকে এদেশের সরকার যক্ষ্মার ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। যার অবশ্যসম্ভাবী পরিণতি এদেশে আরও প্রচুর যক্ষ্মা রোগী বেড়ে যাবে। আর মাল্টি ড্রাগ রেসিস্টেন্ট বা এমডিআর টিবিতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে। এদেশে মোট যক্ষ্মা রোগীর ৪ শতাংশ বা কয়েক হাজার এমডিআর টিবিতে আক্রান্ত। যাদের উপর কোনও ওষুধই কাজ করার নয়।
যক্ষ্মার অন্যতম কারণ অপুষ্টি, অনাহার, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ভোট ঘোষণার সাথে সাথে নেতাদেরও নানা প্রতিশ্রুতি কানে এসে আঘাত করেছে। দেশবাসীর দুঃখে জনতা-জনার্দনের ত্রাতারা ক্যামেরার সামনে হাজার কথা বললেও যক্ষ্মার মত প্রাণসংহারক রোগের জীবনদায়ী ওষুধের সরবরাহ বন্ধ হওয়া নিয়ে কোন শব্দই তাঁরা বলেননি। দেখা গেছে যক্ষ্মায় এমডিআর টিবিতে আক্রান্ত বেশিরভাগই রোগীই দরিদ্র এবং সমাজের প্রান্তিক স্তরের। আমাদের দেশে পিএমসি পদ্ধতিতে মূলত টিবির চিকিৎসা হয়। এখানে দুটো প্রধান ড্রাগ ব্যবহার করা হয় – ইসোনিয়াজিড এবং বিফ্যামপসিন। পিএমসি পদ্ধতিতে ৩ থেকে ৬ মাস কারও ৯ মাস চিকিৎসা চলে। চিকিৎসা মাঝপথে বন্ধ করে দিলে টিবির জীবানুর রেসিস্টেন্ট গড়ে ওঠে। তখন আর এই ওষুধে কাজ হয় না। এই অবস্থাকে এমডিআর টিবি বলা হচ্ছে। গত ১৮ মার্চ দিল্লি রাজ্যকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন টিবির ওষুধ কেন্দ্র সরবরাহ করতে পারছে না। যার অবশ্যম্ভাবী পরিনতি এই ওষুধগুলি দিয়ে আগামী দিন টিবির জীবাণুর সাথে লড়াই করা যাবে না। টিবির জীবাণুর এই সব ওষুধের প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠবে। নতুন করে এমডিআর টিবি আক্রান্ত হু হু করে বাড়বে। প্রাণের বিনিময়ে যার মূল্য দিতে হবে লক্ষ লক্ষ সাধারণ রোগীকে।
বৃহত্তম গণতন্ত্রে নির্বাচন খরচের বহরে প্রথম বিশ্বকে ভারত আজ পেছনে ফেলছে। দফায় দফায় নির্বাচন চলছে। কেন্দ্র থেকে আঞ্চলিক শক্তি তাদের ইস্তেহারে, প্রচারে দান ধ্যানের প্রতিশ্রুতি রোজই বাড়িয়ে চলছে। অথচ আজ কয়েক লক্ষ যক্ষ্মা রোগী যে ওষুধ না পেয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে নীরব এই গণতন্ত্র, নীরব এই দলব্যবস্থা। শাসক বিরোধী সকলেই নীরব। কারণ ভাবটা টিবি তো গরীব লোকের বিষয়। ও নিয়ে এত কথা বলার কি আছে! বড় অন্ধকার সময়। চাকরি, নিরাপত্তা কবেই গেছে। এখন জীবনদায়ী ওষুধের দায়টুকুও সরকার ঝেড়ে ফেলছে।চম্পকনগরীর মতো ২৪ সালের ভারতে এ এক অন্ধকার। মিথ্যার- বিভ্রান্তির আর আলেয়ার। তাহলে আমাদের উপায়? সাধারণ মানুষের গণ প্রতিরোধ আর জোরালো স্বরই হয়ত অবস্থার বদল ঘটাতে পারবে। পথে নামতে হবে সবাইকে। দেশ- রাজ্যে যে অনাচারী শাসকেরা বিষাক্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে চলেছে – তার বিরুদ্ধে একমাত্র উপায় গণ প্রতিরোধ। এই দুর্লগ্নে অন্ধকার চম্পকনগরীতে দাঁড়ানো চাঁদের মত আমাদেরও বলতে ইচ্ছে হয় -‘ এ অন্ধকার চম্পকনগরী, তবু পাড়ি দেয় শিবের সন্ধানে। পাড়ি দেও।’ সত্যের জন্য, অন্ধকার ছিন্ন করার জন্য, ষড়যন্ত্রের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসতে আজ এদেশের জনসমাজের পাড়ি দেওয়া বড় জরুরি হয়ে উঠেছে।