সৈকত মিস্ত্রী
জুন মাসের শুরুতে বেনারস গিয়েছিলাম। টুকটাক কাজ, সাথে পুরোনো কাশীটা আরও একবার দেখে নেওয়া। আসলে কাশী শহরের প্রাচীনত্বের প্রতি, গঙ্গার উপর দাঁড়ানো পুরোনো ঘাটগুলোর প্রতি একটা টান অনুভব করি। একটা সময় কাশীকে বলা হতো বাঙালির ‘দ্বিতীয় হোমল্যাণ্ড’। বাঙালির সেই দিন গিয়েছে। স্থানীয় উত্তর ভারতীয় লোকজন বাদে বাকিটা এখন দক্ষিণীদের আধিপত্য। বহু পুরুষ ধরে বাস করা বাঙালি পরিবারের কোনও উত্তর প্রজন্ম খুঁজলে আজও পাওয়া যাবে। গলিঘুঁজির পাশে জড়ানো কাশীর বহুতল বাড়ির ফাঁক ফোঁকর গলে বেরনো কোনও গলিতে আজও বাঙালির দেখা মিলবে হয়তো। তবে পদে পদে উত্তর ভারতীয় ছাড়া ঠোক্কর খেতে হয় দক্ষিণের দেশের কোনও না কোনও দলের সাথে।
এবার ইউপি বেরলাম লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরদিন। কাশী শুধু প্রাচীন শহর আর ধর্মপীঠই নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী কেন্দ্রও বটে। বিগত দশ বছর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজেপি দেশ শাসন করেছে। এবারটায় তাতে ছেদ পড়ল। বিজেপি জোট কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় ফিরলেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অধরা। তার উপর ইউপির মতো প্রদেশে বিজেপির সামগ্রিক ফলাফলও খারাপ। বহু প্রচার সত্বেও এই কেন্দ্রেও এবার নরেন্দ্র মোদীর জেতার মার্জিন আগের বছরগুলোর থেকে বেশ কম। এত প্রচার- প্রসারের পরিসরে কি ঘটল তবে? জানার একটা বাসনা ছিল। সুতরাং এবারের কাশীযাত্রায় এই জানার চেষ্টার মাত্রাটা নেপথ্যে থেকেই গিয়েছে। তাই তীব্র গরম আর রোদের পীড়নকে উপেক্ষা করে পৌঁছালাম কাশী। এর আগেও বেনারস গিয়েছি বেশ কয়েকবার। ভালো লাগার টানে। দেবদ্বিজে বা যৌক্তিক পারম্পর্যের বাইরে অতিন্দ্রীয়ে আস্থা রাখতে পারি না। ফলে দেবস্থানের প্রতি আমার ভক্তিরও জন্ম হয় না, হয়নি সেভাবে। কিন্তু বহু মানুষের বিশ্বাসের সমাহিত ক্ষেত্রে একটা ভালো লাগা কাজ করে। গঙ্গার তীরবর্তী বহুপ্রাচীন ঘাটগুলি বেয়ে হেঁটে বেড়ানোর সময় ইতিহাস যেন ফিসফাস কথা বলে। অগণন বিশ্বাসী মানুষের চলে বেড়ানোর ছবি, গঙ্গার বুকে সূর্যের আলো, সব মিলিয়ে বেশ ছিমছাম একটা প্রচীন গন্ধ আছে।
নানা সংবাদপত্রে বুথ ফেরত সমীক্ষায় যে ইঙ্গিত দিয়েছিল তাতে এবারও বিজেপি একক সংখ্যা গরিষ্ঠতায় সরকার গড়বে এমনটাই শোনা গিয়েছিল। তো ফলাফলে তার প্রতিফলন হল না। কি ঘটল তাহলে? শব্দভেদী এক্সপ্রেস সময়ের আগেই ছুটছিল। মোগলসরাই স্টেশন পার করার আগে থেকে কথা হচ্ছিল ইউপির দীর্ঘদিনের বাসিন্দা অমরেশ পাণ্ডেজির সাথে। বহুপুরুষ ধরে তাঁরা বেনারস শহরেই থাকেন। বিএইচইউ এর দিকে গৌরীকুণ্ডে ওঁদের বসতি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্রে বিজেপি গত বারের থেকে কম ভোট পেল কেন? পাণ্ডেজির সোজাসাপটা উত্তর – ‘মোদীজি কাজ তো করছেন। পথঘাটের উন্নতি হচ্ছে । তবে কর্মসংস্থানের কোনও দিশা দেখাতে পারেননি। বেনারস শহরে সম্প্রতি নানা বড় বড় নির্মাণ হচ্ছে। সেসব নির্মাণের বরাত জুটছে গুজরাটি কোম্পানির। স্থানীয় মানুষ শুধু চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। আধিপত্য গুজরাটিদের। বহু প্রজন্মের নিজেদের শহরে আজ বেনারসবাসীর কোনও মালিকানা নেই। স্থানীয় বনাম বহিরাগত দ্বন্দ্ব এই ভোটে ইউপিতে কাজ করেছে। জাতিবাদ দিয়ে সমস্যার সমাধান নেই। বাজারে গিয়ে সবাইকেই বেশি দামে জিনিস কিনতে হয়। সেদিকে নজর না দিলে ভোট দেবে কেন লোকে? কথা বলতে বলতে জানালেন পাণ্ডেজি তাঁরা পণ্ডিত বংশ। তাঁর ঠাকুরদা, বাবারা কাশীতে পণ্ডিতবৃত্তি করেছেন। তিনি চাকরি করেন। আসলে দিন বদলাচ্ছে। চাকরি সবার দরকার। সেদিকে নজর না দিলে জাতিবাদ করে কিছু হবে না। ‘দেখুন, ফৈজাবাদে রামমন্দির তৈরির পরও বিজেপি ওই কেন্দ্রে হারলো। কেন জানেন? জমি ইস্যু। কমদামে, নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে যে জমি সরকার স্থানীয়দের থেকে নিয়েছে, সেসব জমি সরকারের থেকে নিয়ে গুজরাটিরা বহুগুণ বেশি দামে বিক্রি করছে, না হয় হোটেল ব্যবসা করছে। স্থানীয়দের লাভ হয়নি। এটা চলে নাকি!’
জাতিবাদ, বিভাজনের কড়া মাদকের নেশা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। রুটিরুজির তাড়না এই মাদকতার থেকে অনেক বেশি। জাতিবাদ কি ডাল-রুটি জোগায়? একথা ইউপির সাধারণ মানুষ বুঝেছে। বুঝেছে এ দেশের নানা প্রান্তের লোকজন। তাই মন্দির নগরী, প্রধানমন্ত্রীর নিজের কেন্দ্রই তাঁর এই নীতির বিপ্রতীপ একটা স্বরকে জানান দিয়েছে। এই স্বর বিভাজনের বিপরীতে, গণতন্ত্রের দিকে হাঁটার একটা ইঙ্গিত। বিভাজনের বিপরীতে ডাল- রুটি- মাকানের রোজকার দাবিকে প্রতিষ্ঠা করেছে।