দিলীপ রায়
বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি নির্বাচন দেখার সুযোগ হয়েছে। লোকসভা, বিধানসভা এবং পুরসভা নির্বাচন। ভোটও দিয়েছি বেশ কয়েকবার। আবার অফিস যাওয়ার তাড়ায় ভোটের লাইনে ভিড় দেখে ভোট দিইনি এমন ঘটনাও ঘটেছে। বিভিন্ন নির্বাচনে বিভিন্ন দলের প্রচারও দেখেছি। এখনও দেখছি। একসময় ভোটের প্রচারে বিভিন্ন দলের নেতারা কি বলছেন তা জানার জন্য পরদিন খবরের কাগজে চোখ রাখতে হতো। এখন লাইভ শোনা যায় বা দেখা যায়। বেঁচে থাকার জন্য সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত জরুরি খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের মূল উৎসব নির্বাচনের সময়ে কিন্তু নিজের দলের পক্ষে প্রচারে নেতারা কখনই এইসব দাবি পূরণের প্রতিশ্রুতিকে সামনে রাখেন না। একটা সময় বিজলি, পানি, সড়ক বা আলো, জল, বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট করতে দেখা যেত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান-সহ অন্যান্য দাবির কথা বলা হলেও প্রচারে সেভাবে আসত না। যদিও, গরীবী হঠাও বা দারিদ্র দূর করার মতো বিষয় নিয়ে ভোট রাজনীতি ছিল। আছে। থাকবেও। আর ভোটের প্রচারে থাকে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের চাপানউতোর।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে ভোটের প্রচারের ভাষা। দারিদ্র দূর করার লক্ষ্যে দেশজুড়ে চালু খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্প-সহ বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পকেও এখন প্রচারের হাতিয়ার করছে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি-সহ বিভিন্ন রাজ্য সরকারে থাকা কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক দল। কিন্তু কোভিড ১৯ বা করোনা অতিমারির ধাক্কায় কর্মহীন বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য কেউই কোনও কথা বলছে না। এমনটা চোখে পড়ছে না যে, বিজেপি বা বিরোধী শিবির কর্মসংস্থান নিয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার বিষয় নিয়ে প্রচার করছে। ‘উন্নয়ন’-এর কথা বলছে সবাই। আর দেশের সুরক্ষা, সনাতন ধর্মের সুরক্ষার জন্য বিজেপি তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কোনও বিকল্প নেই বলে দাবি করছে গেরুয়া শিবির। ভোটের প্রচারে বিরোধীদের দুর্নীতিগ্রস্ত, সনাতন বিরোধী, পাকিস্তান দরদী বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিরোধীরা সরকার গড়তে পারলে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের প্রাপ্য সুবিধা কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের দিয়ে দেবে। কংগ্রেসের নির্বাচনি ইশতেহারে মুসলিম লীগের ছায়া রয়েছে বলে দেগে দিচ্ছেন বিজেপির শীর্ষ নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং। ওই ইশতেহারের বক্তব্যকে বিকৃত করে তিনি প্রচার করছেন যে, বিরোধী জোট বা ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে এসসি, এসটি ও ওবিসিদের সংরক্ষণ বাতিল করে দেবে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যেরও অংশবিশেষ উল্লেখ করে প্রচারে ঝড় তুলেছেন তিনি। অভিযোগ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাধু সন্তদের অপমান করেছেন। রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সংঘ, ইস্কনের মতো প্রতিষ্ঠানকে অসম্মান করেছেন। আংশিক সত্যকে মিথ্যে দিয়ে অতিরঞ্জিত করে ধর্মকে সামনে রেখে ভোট বৈতরণী পার করার চেষ্টা করছেন নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি নেতারা। কোনও জনমুখী প্রকল্প নেই। দেশের জনসংখ্যার বিপুলসংখ্যক কৃষক সমাজের দীর্ঘদিনের দাবি ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করা নিয়ে কোনও বক্তব্য নেই। কেবলই মন্দির নির্মাণ আর ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে মেরুকরণের চেষ্টা করছেন তারা। দেশের পক্ষে এ কোনও শুভ লক্ষণ নয় বলেই জানিয়েছেন রাজনৈতিক মহলের একাংশ। ধর্মকে সামনে রেখে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজ বিপন্ন প্রচার করে এদেশের কোনও রাজনৈতিক দল বা কোনও প্রধানমন্ত্রীকে আগে কখনও প্রচার করতে আমি অন্তত দেখিনি।
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ২০১৪ সালে কেন্দ্রে সরকার গঠন করে বিজেপি। ‘আচ্ছে দিন আনা ওয়ালে হ্যায়’ বা ভালো দিন আসছে স্লোগান দিয়ে ২৮২ আসনে জিতে ক্ষমতায় আসে। কিন্তু আচ্ছে দিন এসেছে কিনা তা যেকোনও মানুষই বেকারত্ব, গ্যাসের দাম আর দ্রব্যমূল্য দেখেই অনুভব করতে পারেন। ২০১৯ সালে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ফের ক্ষমতা দখল করে বিজেপি। কিন্তু প্রতিশ্রুতি মতো কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। ব্যর্থ হয় কালো টাকা উদ্ধারের প্রতিশ্রুতিও। বছরে দু’কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লির মসনদে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু তাঁর জমানায় বেকারত্ব উল্টে বিপুল পরিমাণে বেড়ে যায়। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও)-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে প্রকাশ, ভারতের বেকার জনসংখ্যার ৮০ শতাংশের বেশি যুবক। ইনস্টিটিউট অফ হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (আইআইএইচডি) সঙ্গে যৌথ ভাবে প্রকাশিত ‘দ্য ইন্ডিয়ান এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট ২০২৪’ শীর্ষক এই রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে দশম শ্রেণি বা তার বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা রয়েছে এমন কমবয়সী বেকারের হার ছিল মোট বেকারের ৬৫.৭ শতাংশ। ২০২০ সালে যা ছিল মোট বেকার সংখ্যার ৩৫.২ শতাংশ। বর্তমানে দেশের বেকারদের মধ্যে ৭৬.৭ জন শিক্ষিত যুবক এবং ৬২.২ শতাংশ শিক্ষিত যুবতী। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে দেশে বেকারত্ব কমলেও কোভিড অতিমারির সময় এই হার আবারও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এই সময়ে কাজ হারান বহু সংখ্যক শিক্ষিত এবং পেশাদার মানুষ। দাবি করা হচ্ছে, আর্থিক বৃদ্ধির দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম দেশ হতে চলেছে ভারত। অথচ, এদেশে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে এবং দেশের জাতীয় সম্পদের ৪০ শতাংশই রয়েছে দেশের ১ শতাংশ ধনকুবেরের হাতে। ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের সাম্প্রতিকতম রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ সালে ভারতের ধনীতম ১ শতাংশের উপার্জন ও সম্পদ সর্বোচ্চ হয়েছে। ওই ১ শতাংশের হাতে কুক্ষিগত হয়েছে দেশের মোট উপার্জনের ২২.৬ শতাংশ এবং মোট সম্পদের ৪০.১ শতাংশ। ফলে ‘বিকশিত ভারত’-এর স্লোগান সামনে রেখে ভোটযুদ্ধে নামলেও সাধারণ মানুষ বিজেপির শাসনে যে ক্ষুব্ধ, লোকসভা ভোটের প্রথম দফা হওয়ার পরই তা বুঝতে পারছেন মোদি তথা বিজেপির শীর্ষ নেতারা। তাই হাতিয়ার করেছেন ধর্মকে। আর হিন্দুরা বিপন্ন প্রচার করে এবং বিরোধী দলগুলি ভোটব্যাংকের দিকে লক্ষ্য রেখে সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতি করছে অভিযোগ তুলে ভোটবৈতরণী পার করার চেষ্টা করছেন তাঁরা। স্পষ্টতই বিভাজনের রাজনীতির ওপর ভর করে ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টা করছেন নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি। সফল হবে কিনা তা বলবে ভোটের ফলাফল। তবে একথা বললে ভুল হবে না যে, ভারতীয় গণতন্ত্র যে এক ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে পড়েছে।