দিলীপ রায়
‘এই সেই দেশ এখনও এখানে ওঠে আজানের ধ্বনি / গীতা বাইবেল ত্রিপিটক আর শোনা যায় রামায়ণী / কবি কালিদাস ইকবাল আর গালিবের পদাবলী / হাজার সূর্য চোখের তারায় আমরা যে পথ চলি/ সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনাতে নজরুল।’
শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ও নিজের সুরে সঙ্গীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকার গাওয়া একটি গানের কয়েকটি লাইন এখন খুবই প্রাসঙ্গিক। কারণ, এর মধ্যেই আমাদের সামাজিক কাঠামো ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। পাওয়া যায় ধর্মনিরপেক্ষ দেশের পরিচয়ও। অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে সেই পরিচয় ধ্বংস করে হিন্দু রাষ্ট্রের পক্ষে সওয়াল করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-সহ বিজেপির শীর্ষ নেতারা। আর কোনও ঢাক গুড়গুড় নয়, সোজাসাপটাই মেরুকরণকে অস্ত্র করে ক্ষমতায় থাকতে মরিয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অভিযোগ, তার জন্য তিনি এবং বিজেপির শীর্ষ নেতারা মিথ্যার বেসাতি করছেন। বিরোধী শিবিরকে সনাতন বিরোধী বলে দেগে দিচ্ছেন। কংগ্রেস, তৃণমূল-সহ বিরোধী জোট (ইন্ডিয়া জোট)-এ থাকা বিরোধীদলগুলোর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ তুলে প্রচারে ঝড় তুলছেন তাঁরা। প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি শীর্ষ নেতারা প্রচারে বলছেন যে, ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে সমাজের পশ্চাদপদ অংশ এসসি, এসটি ও ওবিসিদের সংরক্ষণ বাতিল করে তা মুসলিমদের দেবে। এছাড়াও বলছেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ অতীতে বলেছিলেন, দেশের সম্পদে সর্বাগ্রে অধিকার মুসলিমদের। সেই কারণেই সমীক্ষা করার পরিকল্পনা নিয়েছে কংগ্রেস। যাতে দেশবাসীর কষ্টার্জিত অর্থ মুসলিম ও অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া যায়। নির্বাচনি জনসভায় মোদির হুঙ্কার, যত দিন আমি বেঁচে আছি, দলিত জনজাতিদের সংরক্ষণকে ধর্মের ভিত্তিতে মুসলিমদের হাতে তুলে দেব না, দেব না, দেব না! কংগ্রেস এবং তাদের যত সহযোগী রয়েছ, তারা কান খুলে এটা শুনে নাও। পাশাপাশি তিনি বলছেন, কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়া জোটের একটাই কর্মসূচি— তাদের কাছে সবার আগে পরিবার। আজ দেশে যা যা অশুভ তার প্রতীক ইন্ডিয়া জোট। তারা চরম সাম্প্রদায়িক, পরিবারকেন্দ্রিক। আমাদের দিল্লি এই সাম্প্রদায়িকতার নগ্ন রূপ দেখেছে। কংগ্রেস শিখদের হত্যা করেছিল। যারা দোষী তারা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছিল। আমরা তাদের শাস্তি দিই। এছাড়াও নির্বাচনি জনসভায় মোদি বলছেন, কংগ্রেস-সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ক্ষমতায় এলে আপনাদের ব্যাঙ্কের খাতা বন্ধ করে টাকা ছিনিয়ে নেবে। মোদি গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে, তার সংযোগ কেটে সব অন্ধকারে ডুবিয়ে দেবে। মোদি প্রতিটি ঘরে জল পৌঁছে দিয়েছে। ওরা এসে সেই জলের সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। আদর্শ নির্বাচন বিধি চালু হওয়ার পর প্রথমদিকে বিভিন্ন জনসভায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের উন্নয়নমুখী চরিত্র তুলে ধরছিলেন। পাশাপাশি দাবি করেছেন, তাঁর আমলে গোটা বিশ্বের সমীহ আদায় করে কী ভাবে ‘বিশ্বগুরু’র মর্যাদা পেয়েছে ভারত । কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ও অপশাসনের অভিযোগ তুলে প্রচার করেছেন।পাশাপাশি রামমন্দির তৈরি কথাও বলেছেন।
কিন্তু কংগ্রেস নির্বাচনি ইস্তাহার প্রকাশ করার পরই মোদির প্রচারের ধরন বদলে যায়। মোদি অভিযোগ করেন, কংগ্রেসের ইস্তাহারে মুসলিম লিগের ছায়া দেখা যাচ্ছে। রামমন্দির উদ্বোধনে রাহুল গান্ধি, মল্লিকার্জুন খাড়্গেদের অনুপস্থিতির কথা উল্লেখ করে কংগ্রেসকে ‘হিন্দুবিরোধী’ আখ্যা দেন তিনি। পরবর্তীতে বিভিন্ন জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে উন্নয়নের প্রসঙ্গ এলেও মেরুকরণই তাঁর প্রচারের মূল হাতিয়ার হয়ে যায়। অথচ কংগ্রেসের নির্বাচনি ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে যে, শিক্ষানবিশের অধিকার, কৃষকদের ফসলের ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের একটি আইনি গ্যারান্টি , এসসি, এসটি এবং ওবিসিদের জন্য সংরক্ষণের ৫০ শতাংশের সীমা বাড়ানোর জন্য একটি সাংবিধানিক সংশোধনী পাস, একটি দেশব্যাপী আর্থ-সামাজিক এবং জাতভিত্তিক জনগণনা, জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা, অগ্নিপথ স্কিম বাতিল করা, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার জন্য ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নগদবিহীন বীমার ব্যবস্থা, জাতীয় ন্যূনতম মজুরি দৈনিক ৪০০ টাকা করা, প্রত্যেক দরিদ্র ভারতীয় পরিবারকে প্রতি বছর এক লাখ টাকা দেওয়ার জন্য মহালক্ষ্মী প্রকল্পের সূচনা। সরকারি, পিএসইউ-তে নিয়মিত চাকরির চুক্তিবদ্ধকরণ বাতিল করা এবং এই ধরনের নিয়োগের নিয়মিতকরণ নিশ্চিত করা। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে অনুমোদিত পদে প্রায় ৩০ লাখ শূন্যপদ পূরণ করা-সহ একাধিক জনমুখী প্রকল্প। একদিকে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের এই ইশতেহারে মুসলিম লীগের ছায়া স্পষ্ট বলে প্রচার করছেন মোদি। আর অন্যদিকে নিজেকে ঈশ্বর প্রেরিত বলে দাবি করেছেন। বৃহস্পতিবার একটি বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ঈশ্বর আমাকে ২০৪৭-এ বিকশিত ভারতের লক্ষ্য পূরণের জন্য পাঠিয়েছেন। আমার পূর্ণ বিশ্বাস, যত দিন না সেই লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে, আমাকে পরমাত্মা ফিরিয়ে নেবেন না। সম্প্রতি বারাণসীতে এক সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের জবাবে মোদি বলেন, যত দিন মা বেঁচে ছিলেন, আমার মনে হতো, বোধ হয় আমার জন্ম জৈবিক প্রক্রিয়ায় হয়েছে। কিন্তু মা চলে যাওয়ার পরে আমার অভিজ্ঞতা মিলিয়ে বলতে পারি, আমাকে পরমাত্মা পাঠিয়েছেন। সেই জন্যই এত কাজের প্রাণশক্তি। কোনও কাজ আমাকে দিয়ে করানোর রয়েছে। সেই জন্যই আমাকে পাঠানো হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এভাবে নিজেকে ঈশ্বরের দূত বলে দাবি করে অবতার হওয়ার চেষ্টা সফল হবে কিনা তা বোঝা যাবে ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর। তবে বিজেপি সরকার গড়তে পারলে দেশে নরেন্দ্র মোদির মন্দির বেশ কয়েকটি নির্মিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আশার কথা, নির্বাচন নিয়ে গবেষণা করে এমন একটি বেসরকারি সংস্থার প্রাক-নির্বাচনি সমীক্ষায় ‘ভারত দেশটা কি শুধু হিন্দুদের, না কি সব ধর্মের নাগরিকের দেশের উপর সমান অধিকার’, প্রশ্নের জবাবে ৭৯ শতাংশ বলেছেন, ধর্ম যাঁর যাই হোক, দেশে সব নাগরিকের অধিকার সমান। অন্যদিকে ১১ শতাংশ বলেন, দেশ একমাত্র হিন্দুদের। আর ১০ শতাংশ এ বিষয়ে কোনও মতামত দেয়নি। জানা গিয়েছে, ওই সমীক্ষায় মতামত দিয়েছেন ১০,০১৯ জন। ১৯টি রাজ্যে ১০০টি লোকসভা নির্বাচনি ক্ষেত্রের ১০০টি বিধানসভা ক্ষেত্রে চারটি করে বুথে চালানো হয়েছে এই সমীক্ষা। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ৬২ শতাংশ ভোটারের মতে চাকরি পাওয়া ক্রমাগত কঠিন হয়েছে। মাত্র ১২ শতাংশ মনে করেন যে, চাকরি পাওয়া সহজ হয়েছে। ৪৮ শতাংশ মনে করেন জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। ৩৫ শতাংশ বলেন, অবনতির কথা। ২২ শতাংশ ভোটার বলেন, তাঁরা পয়সা জমাতে পারছেন। ৩৬ শতাংশ বলেন, তাঁদের প্রয়োজন মিটছে, কিন্তু পয়সা জমানো যাচ্ছে না। ৫৫ শতাংশ মনে করেন, গত পাঁচ বছরে দেশে দুর্নীতি বেড়েছে। এ জন্য কেন্দ্রকে দায়ী করেন ২৫ শতাংশ। রাজ্যকে দায়ী করেছেন ১৬ শতাংশ। ৫০ শতাংশের বেশি ভোটার ভাবছেন, মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারত্ব— এ দুটোই হবে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনি ইস্যু। এখনও বহু মানুষ মন্দিরকে গুরুত্ব দিলেও মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারত্বকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, এমন মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। ভোটের ফলাফলে এই সমীক্ষার প্রতিফলন কতটা দেখা যাবে জানিনা, তবে সমীক্ষায় সংগৃহীত মতামত কিছুটা হলেও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের মনে আশা জাগিয়েছে।
ঋণ স্বীকার : বহু ভোটার গুরুত্ব দিচ্ছেন মন্দিরকে, তবে মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্ব নিয়েও ভাবছেন অনেকে-অর্ধেন্দু সেন (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ মে ২০২৪)