সুকুমার রঞ্জন সরকার, আলিপুরদুয়ার
দশমীতে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসব দূর্গাপুজোর সমাপ্তি ঘটে। দেবী দূর্গা মেয়ে রূপে অশুভ শক্তির বিনাশিনী, মহিষাসুরমর্দিনী এবং সর্বমঙ্গলা রূপে ৪ দিন পুজো পান। এরপর বিজয়া দশমীর দিন সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে ফের পতিগৃহের উদ্দ্যেশ্য যাত্রা করেন। কিন্তু উত্তরবঙ্গের আম জনতার হৃদয় সায় দেয় না দেবীকে বিদায় দিতে। তাই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় একাদশীর দিন থেকে ৩ দিন ধরে আরেক দুর্গাপুজো হয়। তবে এখানে দেবী দূর্গারূপে পূজিতা হন না, পূজিতা হন ভান্ডানী দেবী রূপে। জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার আদি বাসিন্দা রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে এই পুজো প্রচলিত। বর্তমানে এই পুজোতে সব সম্প্রদায়ের মানুষ সামিল হন। এই পুজোর প্রচলন সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। লোকশ্রুতি অনুসারে একেক এলাকায় একেক রকম তথ্য পাওয়া যায়। কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জের নিজতরফ গ্রামে যে লোকশ্রুতি প্রচলিত, তা হল দশমীর দিন দেবী এই গ্রামের উপর দিয়ে পতিগৃহে ফিরছিলেন। তখন দেবীর মালপত্রবাহিকা অসুস্থ হয়ে পড়লে দেবী ওই গ্রামে অবস্থান করেন এবং তাঁর পুজো করার জন্য গ্রামবাসীদের স্বপ্নাদেশ দেন। মালবাহিকা বা ভান্ডারনীর কাহিনীকে কেন্দ্র করে দেবীর পুজো শুরু হয় বলে দেবীর নাম হয় ভান্ডারনী। পরে লোকমুখে এই নাম ভান্ডানীতে পরিবর্তিত হয়। আবার এই জেলার মাথাভাঙ্গা মহকুমায় যে কাহিনী প্রচলিত, তা হলো দশমীর দিন ওই এলাকা দিয়ে পতিগৃহে ফিরে যাওয়ার সময় পতি শিবের ওপর অভিমান হয় দেবী দুর্গার। কারণ, তাঁকে ৩ দিন বাদেই পিতৃগৃহ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন শিব।
এই অভিমান থেকে দেবী মাথাভাঙ্গা এলাকার রানীরহাট ও পাটছড়া গ্রামে অবস্থান করেন। তখন দেবীর অভিমান ভাঙ্গাতে গ্রামবাসীদের দেবীর পুজো করতে বলেন শিব। দেবীর অভিমানের ভান ও তা শিবের ভাঙ্গানো থেকেই দেবীর নাম হয়েছে ভান্ডানী। অন্যদিকে, জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলায় যে কাহিনীর প্রচলন আছে তা হলো, দেবী পতিগৃহ থেকে মাত্র ৩ দিনের জন্য এসে পুজো গ্রহণ করেন। ফলে অনেক সাধারণ মানুষ বিশেষ করে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ তাঁর পুজো দিতে পারেন না। কারণ, সেই সময়ে দুর্গাপুজো ছিল সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষের বৈভব ও সমৃদ্ধি দেখানোর একটা মাধ্যম। দেবী দূর্গা দশমীর দিন পতিগৃহে ফিরে যাওয়ার সময় এই সাধারণ মানুষজন দেবীর পথ আটকে তাদের পুজো নিতে প্রার্থনা জানান। দেবী বলেন, দশমী অতিক্রান্ত হওয়ায় তিনি দশভুজা রুপে পুজো নিতে পারবেন না। দেবী তখন চতুর্ভুজা রূপে অন্য দেবীর ভান করে পুজো গ্রহণ করেন। তাই দেবীর নাম ভান্ডানী। আরও অনেক লোকশ্রুতি রয়েছে এই দেবীর সম্পর্কে। দেবী ভান্ডানী কোথাও চতুর্ভুজা, কোথাও দ্বিভুজা, কোথাও সিংহবাহিনী, কোথাও দেবীর সঙ্গে গনেশ, কার্তিক, লক্ষী ও সরস্বতী থাকেন, আবার কোথাও দেবীর একক মূর্তির পুজো হয়। যাই হোক দেবী ভান্ডানী এখন উত্তরবঙ্গের লৌকিক দেবী রূপে সর্বজন বন্দিতা এবং লোক সংস্কৃতির বাহক ও ধারক রূপেই পূজিতা হন।