রৌণক মৌলিক, কলকাতা

অঞ্জন দত্ত আগেই জানিয়েছিলেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘কিং লীয়ার’ অবলম্বনে তাঁর সাম্প্রতিকতম বাংলা নাটক ‘আরো একটা লীয়ার’ই বাংলা রঙ্গমঞ্চে তাঁর অভিনীত শেষতম নাটক হতে চলেছে। তবে এই নাটকের বেশ কিছু অভিনয় তিনি করবেন বলেও জানিয়েছিলেন। প্রতিটি অভিনয়েই প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ করে তুলছিলেন দর্শকরা। কিন্তু গত ৬ মে অঞ্জন দত্ত ঘোষণা করেন, ১৭ মে ২০২৫ শনিবার জ্ঞান মঞ্চে ‘আরো একটা লীয়ার’ নাটকের নির্ধারিত অভিনয়টিই তাঁর শেষ নাটকের শেষ অভিনয় হতে চলেছে। কারণ হিসাবে তিনি জানান, থিয়েটার মঞ্চে তাঁর অভিনয়ে শরীরই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। শরীরকে বাদ দিয়ে অভিনয় করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু ৭১ বছরের অঞ্জন দত্তর শরীর তাঁকে যা খুশি তাই করতে বাধা দিচ্ছে। অভিনয়ের পর তিনি অসুস্থ বোধ করছেন। তাই ১৭ মে’র পর আর তাঁকে আর দেখা যাবে না বাংলা রঙ্গমঞ্চে।
শেক্সপিয়ারের ‘কিং লীয়ার’ কমবেশি সকলেই পড়েছেন। বিগত দশকের গোড়ায় সুমন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনার ‘রাজা লীয়ার’ নাটকটিও দেখেছেন অনেকেই, যেখানে লীয়ারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নাটক দুটির মধ্যে কোনো রকম তুলনামূলক আলোচনার ধৃষ্টতা প্রকাশের ঝুঁকি না নিয়েও একটা কথা না বলা দর্শক হিসাবে নিজের কাছে অসততা হবে, তা হল – সুমন মুখোপাধ্যায় তাঁর নাটকে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে রাজা লীয়ার করে তুলতে। অঞ্জন দত্ত হেঁটেছেন ঠিক তার উল্টো পথে; তিনি নিজেকে লীয়ার করে তোলার বদলে, লীয়ারকে করে তুলেছেন অঞ্জন। রাজা লীয়ারের পতনের আখ্যান, অঞ্জনের হাতে হয়ে ওঠে মানুষের চিরকালীন অস্তিত্বজনিত সংকটের দলিল। এই দৃষ্টিভঙ্গি নাটকটিকে আলাদা মাত্রা দেয়—যেখানে শেক্সপিয়ারের ক্লাসিক দার্শনিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নের সঙ্গে মিশে যায় মধ্যবিত্ত জীবনবোধ ও তার সংকটগুলো। নরম বিছানায় মেয়েমানুষ হারানোর দুঃখ, সন্ধেবেলার মদের খরচ, কয়েকটা ঘোড়া ও হাতে গোনা কিছু সেবকের জন্য মাসের শেষ তারিখগুলোয় বাঙালি মধ্যবিত্তের মাছবাজারের অসহায় দর কষাকষিতে রাজা লীয়ারকে অসামান্য হিউমারের সঙ্গে পৌঁছে দেন অঞ্জন। ট্র্যাজেডির মধ্যে এমন হিউমারের প্রয়োগ বাংলা নাট্যমঞ্চের বিরল অভিজ্ঞতাগুলোর একটা। এই নাটকের পদে পদে জীবন, রাষ্ট্র এবং বিশ্ব সম্পর্কে গভীর রাজনৈতিক ও দার্শনিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে; কিন্তু সেই প্রতিটি উচ্চারণকেই অঞ্জন দত্ত মাখামাখি করিয়ে দিয়েছেন হিউমারের সঙ্গে – যা এই নাটককে পূর্বতন সমস্ত ‘কিং লীয়ার’ থেকে করে তুলেছে স্বতন্ত্র।
নাটকটিতে ব্যক্তি-জীবনের সংকট এবং বৃহত্তর রাষ্ট্রিক সংকটের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছেন অঞ্জন দত্ত। একদিকে যেমন জীবনকে একটু দূর থেকে দেখার মতো অভিজ্ঞতার অধিকারী হয়ে রাজা লীয়ার প্রশ্ন করেন – জীবনের মানে কি শুধুই দু’পায়ের মধ্যিখানে থাকা বোকামো? যে বোকামোর জন্য কোনো কারণ ছাড়াই বেঁচে থাকার জন্য অনুপযুক্ত এই পৃথিবীতে মানুষ কিলবিলিয়ে শত-সহস্র অপ্রয়োজনীয় প্রাণের জন্ম দেয়? অন্যদিকে বারবার উত্থাপিত হয় শাসনযন্ত্রের অভ্যন্তরীণ সংকটের কথা। তুলে ধরা হয় হাজার হাজার বছরের শোষণ আর বঞ্চনার ইতিহাসে মানুষ কীভাবে স্রেফ জনসংখ্যায় পরিণত হয়েছে যুগ যুগ ধরে। যেখানে মানচিত্র, দেশ, উদ্বাস্তু, যুদ্ধ, গণতন্ত্র প্রভৃতি শব্দগুলো নেহাতই ক্ষমতার খামখেয়াল মাত্র। নাটকটিতে ব্যক্তিজীবনের যৌন জটিলতাকে মূল দ্বন্দ্বের অন্যতম উপাদান হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। যৌনতা ও রাজনীতির সম্পর্ক এখানে গৌণ নয়, বরং নাটকের এক কেন্দ্রীয় সেতুবন্ধ হিসেবে উপস্থিত। যে সেতু পথিককে জানিয়ে দেয় – পৃথিবীর ইতিহাসে যৌন সংকটগুলো রাজনৈতিক সংকটের থেকে পৃথক করে দেখা এক চরম মূর্খামি মাত্র। যে যৌনতাকে আমরা রাজনৈতিক পরিবৃত্তে চিরকাল গুরুত্বহীন বলে দেগে দিতে চেয়েছি, অথচ সেই যৌন সংকটগুলোই কীভাবে বিশাল বিশাল রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দেয় – শেক্সপিয়ারকে অবলম্বন করে সেই দৃষ্টান্তও এই নাটকের মিতকথনের মধ্যে তুলে ধরেছেন অঞ্জন দত্ত। একটু মন দিয়ে ভাবলে আমাদের এপিক থেকে ইতিহাস – সর্বত্রই কিন্তু এ নজির আমরা দেখতে পাবো।
না, এ’সমস্ত প্রশ্নের উত্তর অঞ্জন দেননি এই নাটকে। জ্ঞান মঞ্চে ঢোকার দরজার মুখেই তিনি লিখে রেখেছিলেন একটা পোস্টার, যেখানে আন্তন চেখভ্‌কে উদ্ধৃত করে লেখা ছিল – ‘নাট্যকারের কাজ প্রশ্ন তোলা। উত্তর দেওয়া নয়।’
জীবনের শেষ নাটকের প্রতিটি উচ্চারণে অজস্র প্রশ্ন উত্থাপন করে প্রসেনিয়াম থেকে বেরিয়ে গেলেন অঞ্জন দত্ত; যাঁকে ঠিকমতো ব্যবহারই করতে পারল না বাংলা রঙ্গমঞ্চ। তবুও একথা অকপটে বলতে পারি, প্রসেনিয়াম থেকে প্রস্থানের ফলে অঞ্জন দত্তর কতটা ক্ষতি হল আমার জানা নেই, কিন্তু বাংলা থিয়েটার নিশ্চিতভাবে আরো একটু দরিদ্র হল – একথা অনস্বীকার্য।

192 Views